কেন সংবিধান পুনঃলিখন প্রয়োজন?

লিপির আলো
By -
0
কেন সংবিধান পুনঃলিখন প্রয়োজন?

সংবিধান পুনঃলিখন নিয়ে যাদের খুব চুলকানি তাদের কাছে একটা প্রশ্ন? সংবিধানের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য সংবিধান?   


জনগণ যেমন নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধান তৈরি করে, সংবিধান রক্ষা করে। তেমনি ভাবে তাদের প্রয়োজনে এটি বাতিল, সংশোধন, পুনঃলিখনও করতে পারে। আপনাকে বুঝতে হবে এটা কোনো ঐশ্বরিক গ্রন্থ নয়, সংবিধান মানুষের তৈরি।  


মূল প্রসঙ্গে আসি। সংবিধান কি? 


জানব তো অবশ্যই তার আগে চলুন কিছু তথ্য জেনে নিই।    

পরিসংখ্যান বলছে- বাংলাদেশের আম জনতার ৮০% এর বেশি মানুষ সংবিধান পড়া তো দূরে থাক কখনো চোখেও দেখে নাই। এমনকি দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও জীবনে কোনোদিন সংবিধান পড়ে নাই।  


আমজনতা রাজনৈতিক নেতাদের কথা তো বাদ ই দিলাম এবার আসি শিক্ষা ক্ষেত্রে। 


নিম্ন মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর লেভেলের ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানেই না সংবিধান কি। তার মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক লেভেলে ৭৩%, উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে ৩৭%, দাখিল লেভেলে ৮৮% এবং আলিম লেভেলে ৬২%।  


এই পরিসংখ্যান থেকেই বুঝতে পারছেন আইন ব্যবসায়ীরা ব্যতিত এই দেশের মানুষের সংবিধান নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। অথচ সংবিধান হলো একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন যা প্রতিটি নাগরিকের জানা অবশ্যীয় কর্তব্য। 


তাহলে সংবিধান নিয়ে এমন উদাসীনতা তৈরির পিছনে কারা দায়ী?  


সুবিধাবাদী দেশ নায়ক,দল এবং আইন ব্যবসায়ীরাই এর জন্য দায়ী। তারা সংবিধানকে জনগণের কাছ থেকে আড়াল করে সংবিধান নিয়ে একচাটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে।  


অথচ উচিৎ ছিল উচ্চ মাধ্যমিকের আগেই পুরো সংবিধান শিক্ষার্থীদের পড়ানো। কারণ নাগরিক হওয়ার জন্য প্রতিটি দেশেই সংবিধান জানা অতীব জরুরী।  


যা বিগত দিনে হয় নাই তার জন্য আর আক্ষেপ করে লাভ কি? এর চেয়ে ভালো আমরা নিজেরা জেনে নিই সংবিধান কি?


সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার লিখিত বা অলিখিত রুপরেখা বা দলিল। যা একটি দেশের জনগণ তাদের অধিকার রক্ষার্থে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণে রচনা করে। অথাৎ একটি রাষ্ট্রের সরকার পদ্ধতি,শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সকল বিভাগের সাথে সরকারের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং মূল আইনগুলো সংবিধানে লেখা থাকে। 


এবং এই সংবিধান মেনে চলা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। কেউ সংবিধান লঙ্গণ করলে সে রাষ্ট্রদোহী। তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।


এখন প্রশ্ন হলো বর্তমানে আমাদের যেই সংবিধান রয়েছে তাতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আপামর জনসাধরণের যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল তার কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে। শুরুতে জনগণের মতামতকে প্রাধাণ্য দিয়ে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল ১৭ বার কাটা ছিড়ার পর তার কতটুকুই বা অবশিষ্ট আছে?  


১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৩০ জন সদস্যকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয় (নানা কারণে ১৯৭২ সালের অক্টোবরে গণপরিষদের সদস্যসংখ্যা ৪০৪ জনে নেমে এসেছিল)।


তাঁদের মধ্যে তিনজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ-দলীয়। অথাৎ একটি দল এই সংবিধান রচনা করেছে এবং যার ফলে তাদের দলীয় চিন্তাধারা এবং আদর্শ এতে প্রতিফলিত হয়েছে।  


আবার স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের আইনি কাঠামো, বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রায় সব বিধিবিধান বাংলাদেশে সংবিধানে বহাল রাখা হয়। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দমনমূলক আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানকে বাতিল বা সংস্কার করার বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এটা ছিল একটা দুর্বলতা।


১৯৭২ সালে প্রণীত হওয়ার পর বাংলাদেশের সংবিধান এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন হয়েছে। প্রথম থেকে চতুর্থ সংশোধনী আনা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ আমলে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতায় থাকাকালে।


সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংশোধনী আনা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময়ে। একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের দুই আমলে। পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ আমলে।


কি বুঝলেন? যেই সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে। তখনই তাদের নিজেদের সুবিধা মত সংবিধান পরিবর্তন করছে। এই যে তারা খাম খেয়ালি অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করেছে এখানে জনগণের অংশগ্রহণ কোথায়? 


আবার সংবিধানে যা লেখা আছে সেগুলো কি সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে? 


সংবিধানের ৪ টি মূলনীতির একটি হলো সমাজতন্ত্র। কিন্তু আমাদের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের জায়গা কোথায়? 


শুধু কি তাই একনায়কতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী করা হয়েছে। এই  সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০ টির বেশি অনুচ্ছেদ সংশোধন বাতিল অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এসব অনুচ্ছেদ সংশোধন বাতিল অযোগ্য করার মানে হলো জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোর কোনোই উন্নয়ন সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- শিক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার নয়। যদি কোনো ভবিষ্যৎ সরকার একে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ১৫ তম সংশোধনীর কারণে তা আর কোনো ভাবেই সংশোধন করা সম্ভব নয়।   


আবার লক্ষ্য করুন সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী আইনে সংবিধানের প্রথম অংশে নতুন একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে অফিস আদালতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।


এই বিধানকেও কোনো সংসদ দ্বারা সংশোধন করা যাবে না, কারণ এটি সংবিধানের প্রথম অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং পুরো অংশটি অসংশোধনযোগ্য করা হয়েছে। 


সংবিধানের মত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এমন প্রহসনের পরও বিকৃত সংবিধান রক্ষার্থেই যাদের চুলকানি তাদেরকে আর কি বলব।  


বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝবেন জনগণ গণতন্ত্র চাইলেও বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের দোলাচালে ভুগেছেন। এবং যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন তিনি সংবিধানে যুক্ত করেছেন তা তিনি এই দেশের জনগণকে স্পষ্ট করে বলতে পারেননি এমনকি তার দলকেও না। ফলে এর প্রভাব একসময় গিয়ে পড়েছে বাকশালের উপর।  


নয়াচীন ভ্রমণের পর থেকেই সমাজতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর মনে জায়গা করে নিয়েছিল এবং এ থেকে তিনি আর বের হতে পারেননি। তাই সংবিধানে অঙ্গিকার নামায় লেখা হয়-  


আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। 


কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাই গণতন্ত্রকে সীমিত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একসময় বাকশালকে বেছে নিয়েছেন। এখানেই এই সংবিধানের প্রথম দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। 


আর সেই দুর্বল সংবিধান যুগে যুগে ক্ষমতালোভী সরকার তার স্বার্থ অনুযায়ী সংশোধন করে আসছে। 


যারা বলছেন কোন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সংবিধান পুনঃলিখন করবেন? তাদেরকে বলছি একটু মন দিয়ে শোনেন, আপনারা কি মনে করেন চাকরিতে কোটার মত এটা সাধারণ বিষয় নিয়ে এত বড় একটা বিপ্লব ঘটে গেল? 


একদমই না। এই বিপ্লব ঘটেছে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য এবং শোষণের কারণে। ১৯৭১ সালেও এই দুইটি কারণেরই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ,নিপীড়ন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণ অস্ত্র ধরেছিল। অথাৎ এই দুইটি বিপ্লব একই সূত্রে গাঁথা। 


তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে আপামর জনগণের নতুন দেশ তৈরির যে স্বপ্ন তা পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ গঠণ করে সংবিধান পুনঃলিখনের এখনই সঠিক সময়।


মুহাম্মদ বাবলু 

লেখক ও গবেষক 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)