বই পড়া এমন একটি মৌলিক দক্ষতা ও অভ্যাস যা শুধুমাত্র পড়াশোনার ক্ষেত্রেই সাহায্য করে না, বরং ব্যক্তিগত বিকাশকেও সমৃদ্ধ করে। বই পড়তে গেলে অনেকেরই ঘুম পায়। তাই না? আজকালকার তথ্য- প্রযুক্তির যুগে সবাই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। অনেকের কাছেই বই পড়া একটি বিরক্তিকর ও একঘেয়ে কাজ। এমন শত বাধাকে অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলা আসলেই একটি চ্যালেঞ্জ। তাই আজকে আমি এমন কিছু প্র্যাক্টিকাল কৌশল বলব যেগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহকে দ্বিগুণ করে তুলবে এবং তাদেরকে একটি ভালো বইয়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে দিবেঃ
১. একটি পঠন-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করাঃ
বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরির প্রথম পদক্ষেপ হলো এমন একটি একটি পঠন-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। একটি ভালো লাইব্রেরি হলো অপরিমেয় জ্ঞানের ভাণ্ডার। একটি আদর্শ লাইব্রেরির বৈশিষ্ট্য হলো এখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই থাকবে এবং বই নেওয়ার ক্ষেত্রে কার্ড করার ব্যবস্থাটিও সহজসাধ্য হবে। এভাবে স্কুল-কলেজের পাশাপাশি এলাকাগুলোতেও পাঠাগার থাকলে যেকোনো বয়সের মানুষ বই পড়তে আগ্রহী হবে। পাঠাগারগুলোতে শুধুমাত্র ভালো বইয়ের সংগ্রহ থাকলেই হবে না, এর সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চেয়ার টেবিল থাকতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠাগারে বসে পড়তেও পছন্দ করবে। এভাবে একটি নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশ গড়ে তোলা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে অত্যাবশক।
২. রিডিং ম্যাটেরিয়াল নির্বাচন করতে দেওয়ার সুযোগঃ
শিক্ষার্থীরা কী পড়বে এটা তাদের নিজেদেরকে নির্বাচন করতে দেওয়া উচিত। পিতা-মাতার উচিত সন্তানদেরকে বিভিন্ন ক্যাটাগরির বইয়ের সাথে পরিচিত করা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, ফিকশান, নন-ফিকশান, সায়েন্স ফিকশান, গোয়েন্দা-থ্রিলার, শিশু-কিশোরদের বই ইত্যাদি। এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ পছন্দের লেখক থাকলে তার বই পড়া দিয়ে শুরু করা যায়। পছন্দের ক্যাটাগরি, পছন্দের লেখকের বই পেলে পড়ার গতি বেড়ে যায়। কেউ যদি নতুন পাঠক হয় তাহলে কঠিন এবং বেশি বড় বই দিয়ে শুরু করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে আগ্রহ বৃদ্ধি না হয়ে কমে যেতে পারে।
৩. দৈনিক রুটিনের মধ্যে বই পড়াকে অন্তর্ভুক্ত করুনঃ
বই পড়াকে দৈনিক রুটিনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন। প্রতিদিন অল্প করে হলেও বই পড়ুন। এতে একটি অভ্যাস তৈরি হবে এবং ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। প্রথম দিকে চাইলে জোরে জোরে পড়তে পারেন। কিন্তু মনে মনে বই পড়া শুরু করলে গতি বৃদ্ধি পাবে এবং দ্রুত একটি পৃষ্ঠা শেষ করতে পারবেন।
৪. বই পড়াকে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত করুনঃ
যখন শিক্ষার্থীরা তাদের পড়া বই এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে সংযোগ খুঁজে পায় তখন পড়াটা তাদের কাছে আরো বেশি আনন্দদায়ক হয়ে যায়। গল্প এবং তার চরিত্রের সাথে বাস্তব জীবনের কোনো ঘটনা বা মানুষের মিল খুঁজে পেলে তা ব্যক্তির চিন্তা শক্তিকে আরো বেশি উদ্দীপিত করে তোলে। সে বুঝতে পারে যে বাস্তবতা এবং বইয়ের মধ্যে কিছুটা হলেও সংযোগ আছে। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতুহলের উদ্রেক ঘটায়। যে বইটি পড়া হয়ে গেছে সেটি নিয়ে বন্ধুমহলের মধ্যে আলোচনা করলে আরো ভালো। কারণ এতে ব্যক্তি এবং বস্তুকে মূল্যায়ন করার দক্ষতাটি উন্নত হয়। বই হলো মানুষের আয়না। আমরা আমাদের আশে-পাশের মানুষকে প্রায়ই বইয়ে খুঁজে পাই। তার কারণ লেখক সমাজের মানুষ এবং তার কৃত কর্মকাণ্ডকেই তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেন। এভাবে আমাদের আশেপাশের মানুষের মাঝেই নানান চরিত্র লুকিয়ে আছে। সেগুলোকে খুঁজে বের করতে শিখুন।
৫. দ্রুত বই পড়ার জন্য কিছু বোনাস টিপসঃ
প্রথমে কঠিন বই দিয়ে শুরু করতে যাবেন না। এতে শুরুতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সহজ একটি বই দিয়ে শুরু করুন।
বই পড়ার সময় হাতে একটি পেনসিল রাখুন এবং সেই পেনসিলকে দ্রুত লাইনের উপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যান। এতে আপনার দৃষ্টি একটি নির্দিষ্ট স্থানে টিকে থাকবে না এবং ক্রমাগত আপনার চোখ নড়া-চড়া করতে শিখবে। এটি দ্রুত বই পড়ার অভ্যাসকে গড়ে তুলবে।
জোরে জোরে না পড়ে মনে মনে পড়ুন। কারণ জোরে জোরে পড়তে গেলে আপনার চোখ, মুখ, মস্তিষ্ক তিনটি অঙ্গ কাজে লাগবে কিন্তু মনে মনে পড়তে গেলে আপনার চোখ এবং মস্তিষ্ক এই দুইটি অঙ্গই কাজে লাগবে। এতে শক্তি কম ব্যয় হবে।
বই পড়ার ক্ষেত্রে একটানা পড়ে যান। বার বার আগে-পিছে দেখতে গেলে আপনার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
ইংরেজি বই পড়ার ক্ষেত্রে আপনি যদি কোনো শব্দের অর্থ বুঝতে না পারেন তাহলে বার বার ডিকশনারি ঘাটাঘাটি করতে যাবেন না। শব্দগুলো পেনসিল দিয়ে আন্ডারলাইন করে ফেলুন। কোনো শব্দের অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে না বুঝতে পারলে কোনো সমস্যা নেই। আপনি শুধু পড়তে থাকেন। বইটি যখন শেষ হয়ে যাবে তখন অজানা শব্দগুলোর অর্থ খুঁজে দেখতে পারেন। এতে আপনার পড়ার ধারাবাহিকতাও নষ্ট হবে না এবং আপনি শব্দের অর্থও জানতে পারবেন।
বই পড়ার সময় মোবাইল হাতের নাগালের বাইরে রাখুন এবং অজানা শব্দের অর্থ গুগলে খোঁজা থেকে বিরত থাকুন। কারণ শুরুর দিকে খুব বেশি চান্স আছে আপনি শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিংবা অন্য কোনো অ্যাপে চলে যাবেন।
বই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং ভালো বই কেনা আমদের জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। তাই বই পড়তে থাকুন, অন্যকেও পড়তে বলুন। এভাবে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের তারা যা পড়বে তা বেছে নেওয়ার অনুমতি দিয়ে, প্রতিদিন পড়ার অভ্যাস তৈরি করে এবং বইকে তাদের জীবনের সাথে সংযুক্ত করে, আমরা তাদের পড়ার জন্য দীর্ঘস্থায়ী আবেগ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারি। এই আবেগ শুধুমাত্র তাদের শেখার ক্ষমতাকেই উন্নত করে না বরং নতুন সুযোগ, ধারণা এবং সম্ভাবনাও উন্মুক্ত করে যা তাদের সারা জীবন উপকৃত করবে।
লেখা ও তথ্য গবেষণাঃ
ক্যারোলিন গমেজ
সহ-সম্পাদক, লিপির আলো
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0মন্তব্যসমূহ