একদিকে ২০২০-২১ সালে অটোপাস। ২০২২ সালে হাফ পাস। ২০২৩ সালে দেড় পাস। ২০২৪ সালে আবারও অটোপাস। অন্যদিকে একই দেশে গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য একধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা, ধনী শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য আরেক ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার যেন একটা হ য ব র ল অবস্থা।
বাংলা, ইংরেজি, মাদ্রাসা, কারিগরি, ক্যাডেট, কওমী এইরকম বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষা পদ্ধতি যেমন চালু রয়েছে, তেমনি রয়েছে একটির সাথে আরেকটির বৈষম্য। দেশে বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজি মাধ্যমকে দেখা হয় উঁচু নজরে। ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়ে তারা শতকরা ৯০% ই ধনী পরিবারের সন্তান। তাদের ক্লাস, স্ট্যাটাস এবং লেখাপড়ার মান সব জায়গাতেই তারা বাংলা মাধ্যমের চাইতে উপরে।
আবার যারা জেনারেল ধারার শিক্ষায় রয়েছে তারা কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে ছোট নজরে দেখে। এতে অবশ্য কারণও রয়েছে, এ ধরণের শিক্ষাপদ্ধতিতে অমেধাবীদের স্থান বেশি। সেখানে ডিপ্লোমা (সরকারি) এই একটি লেভেল বাদে নামমাত্র পড়াশোনা হয়।
সেই তুলনায় ক্যাডেট অনেকটা এগিয়ে আর কওমী শিক্ষার সাথে বর্তমান সময়ের আলোকে যে শিক্ষার প্রয়োজন তার কোনো যোগসূত্র নেই।
একেতো শিক্ষা বলে কিছু নেই-ই তারপর গড়ে উঠলো পরীক্ষা বাণিজ্য। আবিষ্কার হলো পিএসসি,জেসএসসি এর মত পাবলিক পরীক্ষা। আর বছর বছর নতুন নতুন ধরণের শিক্ষাক্রম, নতুন নতুন সিলেবাস।
বলা হলো সৃজনশীল পদ্ধিতে কোচিং বাণিজ্য থাকবে না। দেখা গেল তার উল্টো। এমনকি সামজীক বিজ্ঞান, ইসলাম শিক্ষার জন্যও আলাদা আলাদা প্রাইবের্ড শিক্ষক। কারণ পরীক্ষায় এ প্লাস পেতেই হবে। শুরু হলো অসুস্থ এক প্রতিযোগীতা। এই পদ্ধতিতে বলা হয়েছিল গাইড নোটের দরকার হবে না। কিন্তু দেখা গেল গাইড নোটের পৃষ্ঠার সংখ্যা আরো বেড়ে গেল। একই সাথে বেড়ে গেল দাম। ব্যবসা হলো আগের চাইতে আরো বেশি রমরমা।
এরপর এলো ফিল্যান্ড স্টাইল শিক্ষাক্রম (২০২১-২০২৪)। অনলাইনে গ্রুপ স্টাডির নামে রাত জেগে ফেইসবুকে চ্যাট করার সুযোগ আর অ্যাসাইনমেন্ট এর নামে গেইম খেলার যুগ।
যাইহোক এমন শিক্ষার সাথে যারা বেড়ে উঠেছে তারা যে অটো পাসের দাবিতে সচিবলয় ঘেরাও করবে এতে এত অবাক হওয়ার কি আছে! আমিও অবাক হইনি।
কেন অবাক হবো বলুন? বিগত দিনে অটোপাস তো কেবল পাবলিক পরীক্ষায় হয় নাই। নির্বাচনও তো একটা পরীক্ষা। সেখানেও হয়েছে অটোপাস, আবার সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে একেবারে বিসিএস থেকে শুরু করে সব ধরণের পরীক্ষায় ঘুষের বিনিময়ে নামমাত্র পরীক্ষা দিয়ে হয়েছে অটোপাস। এক কথায় বলতে গেলে অটোপাস তো এখন একটা ট্রেন্ড। একটা জাতি বেড়েই উঠছে অটোপাস করে।
তাই যদি হয় তাহলে আপনি হয়তো ভাবছেন আগের সরকার এবং এই অর্ন্তর্বতীকালীন সরকারের মধ্যে পার্থক্যটা কি?
আরে ভাই এদের হাতে তো আর যাদুর কাঠি নেই যে আপনাদের এত বছরের খাই খাই অভ্যাস একদিনে ঠিক করে দেবে। কালকে যদি এই সরকারই সচিবলায়ে আর্মি বিজিবি পাঠিয়ে ছাত্রদের উপর লাঠি চার্জ করতো। তাহলে আপনিই বলতেন ছাত্ররা আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করলো এখন তাদের উপরই নির্যাতন করা হচ্ছে। সমন্বয়কেরা ক্ষমতায় বসে শিক্ষার্থীদের কথা ভুলে গিয়ে এখন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।
অটোপাসের দাবি যেমন অযৌক্তিক, তেমন কিছু কিছু দাবি যৌক্তিকও রয়েছে। তবে তার জন্য কিছুটা সময় দিতে হবে। গত ১৬ বছর ধরে আপনাদের এত দাবি দাওয়া কোথায় ছিল? তখন তো কাউকে দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে দেখেনি। পুরো রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ভাঙা একটা সরকার সেগুলোই ঠিক করবে নাকি আপনাদের দাবি দাওয়া পূরণ করে বেড়াবে।
শিক্ষার বৈষম্যের কথায় যদি আবার ফিরে আসি। তাহলে বলব শিক্ষা কোনো ব্যবসা নয় এটা মৌলিক অধিকার। আইন যেমন সবার জন্য সমান শিক্ষাকেও হতে হবে তেমন ধনী,গরীব, জাত, পাত নির্বিষে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য সমান। গ্রাম এবং শহরে একই ধরণের শিক্ষার সুযোগ থাকতে হবে। সকল ধরণের শিক্ষা মাধ্যমের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হবে এবং বৈষম্য দূর করতে হবে।
সব থেকে জরুরী বিষয় হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে এবং গোঁড়ামি ছাড়তে হবে। এটা আমাদের মধ্যে প্রকট রুপ ধারণ করেছে। এবং আমাদেরকে অন্ধ বানিয়ে ফেলেছে। তাই আমরা ডিগ্রি পাস এবং বিএসসি পাসকে আলাদা ভেবে গুলিয়ে ফেলছি। কিছুদিন আগেই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা যখন বললো তারা বিএসসি পাস চায় আমরা মনে করলাম যে তারা মনে হয় বিএসসি অনার্স এর কথা বলছে। কিন্তু তারা যদি বলত তারা ডিগ্রি পাস চায় তাহলে আর বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা সরব হতেন না। আরে ভাই ডিগ্রি পাস আর বিএসসি পাস তো একই জিনিস। এটা হচ্ছে পাস সমমান, অনার্স সমমান নয় যা এইসএসসির পরে চার বছর লেখাপড়া করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা অর্জন করে।
প্রশ্ন হলো ডিপ্লোমা-অলারাই চাইবে না কেন? এসএসসি+৫ শ্রেণী পাঠ করলে হয় ডিগ্রি আর এসএসসি+৪ শ্রেণী পাঠ করলে ডিপ্লোমা। ডিগ্রিতে ফাইনাল পরীক্ষা ৩ টি। ডিপ্লোমাতে ৮টি। ডিগ্রি থেকে ডিপ্লোমাতে পড়ানোও হয় ডাবল ক্রেডিট। কিন্তু এরপরও ডিপ্লোমা-অলারা জানে না যে তাদের সার্টিফিকেট কিসের সমমান? ডিগ্রি নাকি এইচএসসি না অন্যকিছু?
এই ব্যর্থতা আসলে কার? শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি নির্দিষ্ট করে এর কোনো সমাধান না দিতে পারে তবে এই শিক্ষা পদ্ধতি বাতিল করুক। কিন্তু যদি আগের সকারের মত বলে ২ বছরের অভিজ্ঞতা সনদের ভিত্তিতে বিএসসি পাস সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। তাহলে বলব সেটা হবে একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এইভাবে দিলে বিএসসিদেরকেও ২ বছরের অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে এমএসসির সার্টিফিকেট দিতে হবে। এমনকি সকল সেক্টরে এটা করতে হবে। এটা কোনো যৌক্তিক সমাধান হতে পারে না। আর এমন কিছু বাস্তবায়ন করাও কখনো সম্ভব নয়।
সেক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে ডিপ্লোমাকে ডিগ্রি সমতুল্য করে বিএসসিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া। অথবা অন্য যে ২/১ টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমাদের ভর্তির সুযোগ রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে ডুয়েট এর মত আরো কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করা এবং সেখানে ডিপ্লোমাদের জন্য ৩ বছর মেয়াদি বিএসসি কোর্সের ব্যবস্থা করা। একইভাবে মেডিক্যাল,নার্সিং,কৃষি সহ যত ধরণের (৪বছর মেয়াদী) ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে সকল জায়গায় এই পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
আমি মনে করি তাতে বৈষম্য কমবে। এইভাবে প্রত্যেকটা সেক্টরের বৈষম্য কমাতে পারলেই শিক্ষা ব্যবস্থার সুদিন ফিরে আসবে ইনশাল্লাহ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0মন্তব্যসমূহ