খোঁটা
জান্নাতুল ফেরদাউস
"আমার বাড়িতে এসব চলবে না" কথাটা শোনা মাত্রই প্রভার প্রদীপ্ত মুখখানিতে নেমে এলো একরাশ কালো মেঘ। চারদিক টা যেন নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার স্বামী দৃপ্তর দিকে। চেনা মানুষের অচেনা রূপে বাকরুদ্ধ প্রভা।
দৃপ্ত এবং প্রভার পনেরো বছরের ভালোবাসার সংসার। অনেক যত্নে সাজানে গোছানো পরিপূর্ণ সংসার। তাদের সংসার আলোকিত করে রেখেছে তাদরে দুই রাজকন্যা মায়া ও ছায়া। স্বামী, কন্যাদের নিয়ে বেশ সুখেই আছে প্রভা৷ স্বামীর প্রতি নেয় কোনো আবদার, নেই কোনো অভিযোগ।
কিন্তু আজকে দৃপ্তের বলা কথাটা কোনো মতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। আমার বাড়ি? কিভাবে বলতে পারলো দৃপ্ত কথাটা? বাড়িটা কি শুধু একারই দৃপ্তের? তাহলে প্রভা কে? প্রভার পরিচয় কি? এ বাড়ি এ সংসারে তার অস্তিত্ব কি? নানা প্রশ্নে মন আজ জর্জরিত প্রভার।
সন্তানদের কথা ভেবে নিজে মাস্টার্স পাশ করা সত্ত্বেও কখনো চাকরি করার কথা ভাবেনি প্রভা। নিজের সবটুকু উজার করে স্বামী, সন্তাদের যত্নে নিজেকে নিবেদন করেছিলো। প্রতিদিন এই দায়িত্ব পালন করতে করতে প্রভা হারিয়ে ফেলেছে তার আমার আমিকে। সে ভুলেই গিয়েছিলো তার নিজস্ব সত্তাকে। তার শখ আল্লাদ পুরোটার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এই সংসার।
আসলে মেয়েদের কি নিজের বলে কিছু নেই? ছোট বেলা থেকেই প্রভার ঘুরতে যাওয়ার খুব শখ ছিলো। তার বাবা মা অনেক রক্ষণশীল হওয়ার কারণে কখনও দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি।
ভেবেছিলো বিয়ের পর স্বামীর সাথে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াবে। এক সাথে পাহাড় - সমুদ্র দেখবে। কিন্তু স্বামী দৃপ্তের ঘুরতে যাওয়া পছন্দ নয় বলে দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি কখনও। তাছাড়া স্বামীকে বহুবার ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি। তাই প্রভার মনের কোণে কোথায় জানি একটা আক্ষেপ রয়েই গেছে।
প্রভার মেয়েরা এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। তারা নিজের খেয়াল নিজেরা রাখতে পারে। তাছাড়া কাজের মেয়ে ময়না তো আছেই ওদের সাহায্য করার। দুই তিনদিনের জন্য রান্না করে ফ্রিজে রেখে যেতে পারবে। দৃপ্তের ও আর খাওয়া দাওয়াই সমস্যা হবে না। সব পরিকল্পনা করেই প্রভা দৃপ্তকে একটা মেয়েদের
ট্রাভেল গ্রুপের সাথে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু দৃপ্তের প্রতিউত্তর শুনে পুরোই নির্বাক প্রভা। নিজের অস্তিত্বকে যেন হারিয়ে ফেলেছে।
এত বছরের সংসার, এই বাড়ি - ঘর সবই কি দৃপ্তের? তাহলে প্রভার ভূমিকা কি ছিলো? আজ এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য, নিজের অপূর্ণ ইচ্ছের পূর্ণতা দেওয়ার অধিকারটুকু প্রভার নেয়। মনে হচ্ছে জীবনটা যেন পুতুলের মতো হয়ে গেছে। মেয়েদের কি নিজের কোনো শখ আল্লাদ থাকতে পারে না? নাকি মেয়েদের শখ- ইচ্ছে থাকাটাও এই সমাজের চোখে ভুল?
দৃপ্তের এই এক খোঁটায় প্রভার সব অব্যক্ত ইচ্ছেগুলো যেন দুমড়ে মুচড়ে বুকের ভিতরে খরস্রোতা এক নদী হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যে রক্ত ক্ষরিত নদীর জল দৃপ্ত হয়তো কোনোদিনই দেখতে পাবে না।
সমাপ্ত
onk sondur hoyche golpo ta
উত্তরমুছুন