শিশু হলো অফুরন্ত সম্ভাবনার এক পূর্ণাঙ্গ মানবসত্তা। তারা হলো ভবিষ্যত জাতির রূপকার। প্রতিটি শিশুর মধ্যে লুকায়িত থাকে সুপ্ত প্রতিভা। উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা পেলে তার পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে। শিশুর এই বুদ্ধিমত্তা বিকাশে একজন শিক্ষক সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখেন।
সাধারণত, বুদ্ধিমত্তা বিকাশ বলতে আমরা কি বুঝি? এটি হচ্ছে মূলত কতগুলো দক্ষতা ও কৌশলের সমষ্টি যেমন- যেকোনো পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলা, বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে বুঝতে পারা, সমস্যা সমাধান করতে পারা, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারা প্রভৃতি বিষয় সমূহকে বোঝায়। আলফ্রেড বিনে (Alfred Binet) বলেন, ‘বুদ্ধি হল বোধশক্তির সম্পূর্ণতা, উদ্ভাবনপটুতা, কোন কাজে অধ্যবসায় এবং সমালোচনামূলক বিচার শক্তি। ‘
শিক্ষক কীভাবে শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে?
শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক শিশুকে জানা-অজানার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। তাদের চিন্তার বিকাশ সাধনে, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে উৎসাহ প্রদান করেন। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ এবং বুদ্ধিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন কলা ও কৌশল ব্যবহার করেন।
হাওয়ার্ড আর্ল গার্ডনার, আমেরিকান বিকাশমান মনোবিজ্ঞানী তার “Frames of Mind” গ্রন্থে “একাদিক বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব” (Theory of Multiple Intelligence) উপস্থাপন করেছিলেন। তার মতে, একটি শিশুর বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। এ বুদ্ধিমত্তার মাত্রাও সবার সমান নয়। সাধারণত, কেউ একটিতে ভালো হলে, অন্যটিতে দুর্বল হতে পারে। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক যথাযথ কৌশল ব্যবহার এর মাধ্যমে শিশুদের ভালো ও দুর্বল বুদ্ধিমত্তাগুলো চিহ্নিত করেন। শিক্ষকের কিছু কৌশল ও কার্যক্রম প্রয়োগ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিমত্তা প্রখর হয় এবং শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভরশীল হয়। যার ফলে শিশু তার পছন্দের বিষয় আগ্রহ নিয়ে শেখে, এবং তার শিখন আনন্দদায়ক হয়।
হাওয়ার্ড গার্ডনারের উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিমত্তাগুলো হলোঃ
১) মৌখিক বা ভাষাতাত্ত্বিক বুদ্ধিমত্তা (Verbal / Linguistic Intelligence): সাধারণত, শব্দ বা ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে কোন কিছু প্রকাশের দক্ষতাই হলো মৌখিক বা ভাষভিত্তিক বুদ্ধি। এই বুদ্ধিমত্তার মধ্যে রয়েছে, শিশু গান, গল্প, ছড়া, ঘটনা, তথ্য ইত্যাদি সঠিকভাবে মনে রাখতে, লিখতে বা বলত পারবে। এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশু লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিতার্কিক, উকিল ইত্যাদি হতে পারবে।
কোন শিশুর মধ্যে এই বুদ্ধিমত্তা দেখতে পেলে শিক্ষকের করণীয়ঃ
শিশুকে প্রচুর পড়তে, বলতে ও লিখতে উৎসাহিত করতে হবে।
পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে।
শিশুর পছন্দের নতুন নতুন বই, রঙ্গিন ছবিযুক্ত বই দিতে হবে।
এসবের ফলে শিশুর ভাষার দখল বাড়বে, জ্ঞান বাড়বে, মন উদার হবে। সেইসাথে তার বুদ্ধিরও বিকাশ হবে।
২) যৌক্তিক / গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা (Logical / Arithmetical Intelligence): যুক্তিমূলক ও গাণিতিক প্রয়োগের দক্ষতাই হলো যৌক্তিক বা গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তি প্রদান, বিচার বিশ্লেষণ, ও গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারা। এসব শিশুরা গণিতবিদ, প্রকৌশলী, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, চিকিৎসক ইত্যাদি কাজে এরা সবচেয়ে ভাল করবে।
কোন শিশুর মধ্যে এই বুদ্ধিমত্তা দেখতে পেলে শিক্ষকের করনীয়ঃ
পরিমাপ ও হিসাব-নিকাশের কাজে শিশুকে সম্পৃক্ত করা, বিভিন্ন আকৃতি ও বর্ণের নানা বস্তু ও খেলনা, ইত্যাদি দেয়া, সংখ্যার ধাঁধাঁ সমাধান করতে দেয়া, জ্যামিতিক এবং প্রতীকি সমস্যার সমাধান করতে দেয়া, ক্যালেন্ডার, ঘড়ি, টাইমার, ক্যালকুলেটর ইত্যাদির ব্যবহার শেখানো, ও এগুলো শিশুকে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা, ইত্যাদি।
৩) শারীরিক গতিমূলক বুদ্ধিমত্তা (Body / Kinesthetic Intelligence): এই বুদ্ধিমত্তা বলতে বোঝায়, শরীরচর্চামূলক ক্রিয়াকলাপ এবং শরীর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ করাকে। এ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শিশু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে সহজে মনের ভাব প্রকাশ ও বিষয়বস্তু বুঝতে পারে। এরা খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। এই বুদ্ধিমত্তার অধিকারী শিশুরা এথলেট, সাঁতারু, খেলোয়াড়, অভিনয়, নৃত্যশিল্পী ইত্যাদি হতে পারবে।
কোন শিশুর মধ্যে এই বুদ্ধিমত্তা দেখতে পেলে শিক্ষকের করণীয়ঃ
শিশুকে অভিনয়, নাচ, শরীরচর্চা, সাঁতার কাটা, জিমন্যাস্টিকস, দৌড়ানো, খেলা, সাইকেল চালানো ইত্যাদি চলাফেরা বা শারীরিক নড়াচড়ামূলক কাজ করতে দেয়া। এবং বিভিন্ন শারীরিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উৎসাহ দেয়া।
৪) দৃষ্টি বা স্থানসংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা (Spatial Intelligence): এ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শিশুদের বহুমাত্রিক চিন্তার দক্ষতা থাকতে পারে যেমন- কোন ছবি দেখে কল্পনা করতে পারা, বুঝতে পারা, আঁকতে পারা এবং তা ব্যাখ্যা করতে পারে। তাছাড়া কোন স্থানের বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষণ করা ও তার পার্থক্য অনুমান করতে পারে এবং সৃজনশীলতার সাথে কোন স্থানকে নিজের সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করতে পারে। এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশুরা কারিগর, মিস্ত্রী, চিত্রশিল্পী, স্থপতি, ফটোগ্রাফার, ইনটিরিয়র ও ফ্যাশন ডিজাইনার ইত্যাদি হতে পারবে।
কোন শিশুর মধ্যে এই বুদ্ধিমত্তা দেখতে পেলে শিক্ষকের করণীয়ঃ
শিশুকে তার মনের ভাবের বহিঃপ্রকাশের জন্য তথ্য উপস্থাপন করতে মানচিত্র, ছবি, নক্সা, পোস্টার, বুলেটিন, ইত্যাদি ব্যবহার করতে, গ্রাফ বা লেখচিত্রের সাহায্যে কোনকিছু উপস্থাপন করতে এবং তথ্য বর্ণনার জন্য বিচিত্র রং, আকৃতি, ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা।
৫) সঙ্গীতমূলক বুদ্ধিমত্তা (Musical / Rhythmic Intelligence): গান-বাজনা, বিভিন্ন শব্দ শোনা, চিনতে পারা ও শব্দ অনুকরণ করার ক্ষমতা এ বুদ্ধিমত্তার মধ্যে পড়ে। টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ, ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ এদের আকৃষ্ট করে। এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশুরা সহজেই শিল্পী, সুরকার, শব্দ পরিচালক, বাদক, আবৃত্তিকার, উপস্থাপক, সুবক্তা ইত্যাদি হতে পারবে।
শিক্ষক এ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সঙ্গীতচর্চার সুযোগ দিতে হবে, নানা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতে হবে, সুর সৃষ্টি, আবৃত্তি, উপস্থাপনা ইত্যাদি কাজে উৎসাহ দিতে হবে।
৬) আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা (Inter-personal Inteilligence): অন্যের সাথে সফলভাবে মিশতে পারা, তাদের বুঝতে পারা, সুসম্পর্ক বজায় রাখাক ও সামাজিক জীবনে নিয়োজিত হওয়ার সামর্থ্যকে আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা বলে। এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশুরা নেতা, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, উদ্যোক্তা, শিক্ষক, প্রশিক্ষক হলে ভাল করবে। এরা বর্হিরমূখী (Extrovert) ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
একজন শিক্ষক হিসেবে শিশুর নেতৃত্বের গুণকে স্বীকৃতি দেয়া, শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় তার মত নেয়া, ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দেয়া, বিখ্যাত নানা বই ও বিখ্যাত মহিষীদের জীবনী পড়তে দেয়া ইত্যাদি।
৭) অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা (Intra-Personal Intelligence): এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশুরা মনোবিজ্ঞানী, সমালোচক, লেখক, কলামিস্ট, ছবি পরিচালক, বিজ্ঞানী, কবি ইত্যাদি হতে পারবে। কারণ তাদের নিজেকে বুঝতে পারার সামর্থ্য রয়েছে। তারা নিজের শক্তি, দূর্বলতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বা উপলব্ধি এবং সে অনুসারে কাজ করার সামর্থ্য রাখে। এরা অন্তর্মুখী (Introvert) ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
এদের প্রতি শিক্ষকের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। শিশুর নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশকে উৎসাহিত করা, শিল্প, সাহিত্য পত্রিকায় লিখতে উৎসাহ দেয়া, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজের পরিকল্পনা করতে ও সেইমত কাজ করতে দেয়া। সমালোচনা, উপহাস, নিরুৎসাহিত না করা।
৮) প্রকৃতিবিষয়ক বুদ্ধিমত্তা (Naturalistic Intelligence): প্রকৃতিকে ইচ্ছামত সংশ্লিষ্ট ও ব্যবহার করার সামর্থ্য। শিশু বা ব্যক্তি উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রজাতি চিহ্নিত করতে পারবে, প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে অভিনব উপায়ে ব্যবহার করতে পারবে। এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশুরা চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষিবিদ ইত্যাদি হতে পারবে।
এক্ষেত্রে শিক্ষক শিশুকে প্রাকৃতিক পরিবেশে সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া, বাগান করতে সাহায্য করা, জীবজন্তু, জীবজন্তুর ছবি দেখানো, শিশু প্রাকৃতিক জিনিসের অভিনব ব্যবহার উদ্ভাবন করতে উৎসাহ দেওয়া।
পরিশেষে, শিক্ষক হলেন জাতি গড়ার কারিগর। তার সংস্পর্শে শিশুর অন্তর্নিহিত বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সাধন সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন সঠিক শিখন-শেখানো কৌশল অনুসরণ এবং শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তা অনুধাবন করে সে অনুযায়ী কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া এবং তাদের উৎসাহ দেওয়া।
জান্নাতুল ফেরদাউস
সহকারী শিক্ষক
রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0মন্তব্যসমূহ