মীর মশাররফ হোসেনকে নিয়ে রাজবাড়ীতে তরুণ প্রজন্মের নতুন সংগঠণ ‘মীর মশাররফ হোসেন কালচারাল একাডেমি’

লিপির আলো
By -
0




মীর মশাররফ হোসেন কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠার পূর্ব প্রেক্ষাপট:


কত কত সভ্যতা, সম্রাট ও সাম্রাজ্য কালের পরিক্রমায় পৃথিবী থেকে আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু সব যুগ,কাল বা সময়কে অতিক্রম করে আজো বেঁচে আছে কিছু কালজয়ী মানুষের অমর সৃষ্টি। আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের জনক মীর মশাররফ হোসেন তেমনই একজন কালজয়ী পুরুষ। তার অমর সৃষ্টি কেবল বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধই করেনি ঘটিয়েছে আধুনিক মুসলিম সাহিত্যে বিপ্লব। তার লেখনি ধর্ম জ্ঞানহীন মুসলমানদেরকে যেমন দেখিয়েছে আলোর দিশা, তেমনি হয়ে উঠেছে সমাজের অন্যায়-অনিয়ম ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের হাতিয়ার।


রাজবাড়ি জেলার (আমরা যাকে বলি প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজা-পাড়া গ্রাম) পদমদী কেবল এই মহান পুরুষকেই লালিত করেনি একই সাথে এই প্রত্যন্ত গ্রামটিই উনিশ ও বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হয়ে উঠেছিল শিক্ষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। মীর মশাররফ হোসেনের জ্ঞাতি ভাই শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক নবাব সৈয়দ মীর মোহাম্মদ আলী এই পদমদী গ্রামেই ১৮৪৫ (মতান্তরে ১৮৪০) সালে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার প্রথম বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। অথচ আজ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সেই ঐতিহ্যর ধারক পদমদী আজ নির্জীব,অবহেলিত একটি অজা পাড়া গ্রামে পরিণিত হয়েছে।       


আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৬০৭ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ইসলামি ধর্মগুরু এবং ইরাকি অভিবাসী ইসলাম ধর্ম প্রচারক সৈয়দ শাহ পাহলোয়ানের নির্দেশে এই পদমদীতে যে জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই জমিদার বাড়ি (যা নবাব বাড়ী নামে পরিচিত) তার ধবংসাবশেষের একটুকরো ইটও আমরা স্মৃতি হিসাবে রাখতে পারিনি।  


কেবল তাই নয়, জগৎ বিখ্যাত বোগদাদ নগর হতে শাহ সাদুল্লা ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে করতে যে এই এলাকায় এসে একদিন উপস্থিত হয়েছিল তাই বা আমরা ক’জন জানি। সেই ইসলাম ধর্মের প্রচারক শাহ সাদুল্লারই বংশধর পদমদীর মহাকালের মহাপুরুষ সাহিত্যর অগ্নিপুত্র ও নব মুসলিম চেতনার কাণ্ডারি কালজয়ী ‘বিষাদ সিন্ধুর’ স্রষ্টা মীর মশাররফ হোসেন।  


অথচ যে নবাব বাড়ীর ভাঙ্গা ইটের আক্ষেপ আমি করছি; সেই ভাঙ্গা ইটের স্তুপের নিচেই দীর্ঘ অর্ধশত বছর চাপা পড়ে ছিল এই মহান পুরুষের কবর। যা ১৯৬১ সালে প্রথম শ্রদ্ধীয় ফকির আব্দুর রশীদ স্যারের অগ্রণী ভূমিকায় জনসম্মুখে আসে।  


পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থার অর্থানুকূল্যে মীর মশাররফ হোসেনের কবরটি সংস্কার করা হয়। রাজবাড়ী সাহিত্য মজলিস, রাজবাড়ী সাহিত্য পরিষদ, রাজবাড়ী থেকে প্রকাশিত (১৯৬৫-১৯৬৮) মাসিক ‘চন্দনা’ পত্রিকা ও ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি পরিষদের মাধ্যমে পদমদীতে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়ে স্মারক লিপি প্রদান করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। 


এরপর সরকারী অর্থানুকূল্যে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগ ও পরিচালনায় মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০১ সালের ১৯শে এপ্রিল এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।  



মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রের বর্তমান বেহাল অবস্থা এবং এর কারণ: 


মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রের যে দৈন দুর্দশা তা বলতে আমার খারাপ লাগে। এর প্রথম কারণ হলো পদমদী গ্রামের সন্তান হয়ে আমরা কালজয়ী এ মহৎ মানুষকে আজো চর্চা করে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয়ত আমাদের সাহিত্য বিমুখতা এবং উদাসীনতা।


বাংলা একাডেমি যে লক্ষ্যে ২০০১ সালে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপন করেছিল তা সত্যিকার অর্থে পূর্নতা পায়নি। বরং যে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র আলোর মুখ দেখেছিল তা আজ অযত্নে অবহেলায় আবারও ম্লান থেকে ম্লান হয়ে পড়ছে। 


এই ঘাস, লতা পাতায় বন হয়ে যাওয়া কিংবা পাঠাগার, সংগ্রহশালা, অডিটোরিয়াম রুমের তালায় মরচে ধরার অন্যতম কারণ পর্যটক, দর্শনার্থী, সংস্কৃতি কর্মী, গবেষকদের নিয়মিত পদচারণার অভাব।  


যার ফলে সমাধিসৌধে প্রবেশের সামনের ফটকে চেয়ার পেতে বসে একজন স্টাফ ঝিমায়। এবং আরেকজন দূরে বসে ঘুমায়। মাঝে মাঝে ছাগল চড়তে দেখা গেলেও উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়া সাধারণত দর্শনার্থীদের দেখা যায় না। 


কবুতর, মুগরী, গরু, ছাগল কিংবা পাখিদের অভয়ারণ্য হলে তাতে ক্ষতি নেই। ক্ষতি হলো মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে মানুষের মাঝে চর্চা না থাকায়। এবং মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রটি পর্যটক বান্ধব না হওয়ায়। 



‘মীর মশাররফ হোসেন কালচারাল একাডেমি’র পরিচিতি উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য:  


উপরোক্ত পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে মীর মশাররফ হোসেনকে নিয়ে পদমদী তথা পুরো বাংলাদেশে চর্চা, গবেষণা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তার অমর কীর্তি তুলে ধরতেই ‘মীর মশাররফ হোসেন কালচারাল একাডেমি’র আবির্ভাব।  


উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য: 


১. মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্লাটফর্মে পরিণিত করা। 


২. মীর মশাররফ হোসেন ও পদমদীর ইতিহাস -ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করা। 


৩. সারা বছর বিভিন্ন কালচারাল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মীর মশাররফ হোসেন এর অমর সৃষ্টি জনসাধারণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।  


৪. মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রে গড়ে তোলা পাঠাগারকে পাঠকমুখী করতে স্থানীয় শিক্ষার্থীদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। 


৫. প্রতি বছর সমগ্র বাংলাদেশের নবীণ-প্রবীণ লেখক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে ‘মীর মশাররফ হোসেন জাতীয় কালচারাল উৎসব’ উদযাপন করা।  


৬. সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলায় একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ এবং একটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশ করা। 


৭. মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম, মৃত্যু বার্ষিকীতে কালচারাল প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা।  



মীর মশাররফ হোসেন কালচারাল একাডেমির বর্তমান গবেষণার বিষয়বস্তু: 


গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ও প্রবন্ধ “পদমদীর মীরনামা”    


শৈশবে যে নবাব বাড়ীর গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি। যে নবাব বাড়িতে এক সময় হাট বসত, মেলা হত। স্থানীয় মানুষের সেই নবাব বাড়ী নিয়ে রয়েছে নানান জনশ্রুতি এবং ভৌতিক অভিজ্ঞতা। নবাবদের নিয়ে লোকমুখের সেসকল জনশ্রুতি, প্রবীণদের অভিজ্ঞতা এবং নবাব বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বিলীন হওয়ার গল্প, নবাবের ঘাট, বাদীর ঘাট, নীল কুটি, গোয়ালবাড়ী, সোনাই ডাঙ্গার বিলে সোনা রুপার প্লেট, নবাববাড়ী পুকুরে কুমিরের গল্প, অত্যচারী নবাবদের গল্প, মীর মশাররফ হোসেন একজন জমিদার ও সাহিত্যিক, মীর মশাররফ হোসেন কমপ্লেক্স স্থাপনের দিনগুলো, মীর বংশের উল্লেখযোগ্য সমাজ হিতৈষী ব্যাক্তিত্বের অবদান, মীর মশাররফ হোসেন কমপ্লেক্স এর দুর্দশা কারণ এবং উত্তরণের উপায়, মীর মশাররফ হোসেনকে নিয়ে সর্বস্তরে চর্চা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এ বইয়ের আলোচ্য বিষয়। 


বইটি আগামী বছর অমর একুশে বইমেলা এবং বিশ্বব্যাপি অ্যামাজন কিন্ডল ডাইরেক্ট পাবলিশিং, কবো রাইটিং লাইফ এবং ভারতের নোশন প্রেসে প্রকাশিত হবে। 



বাংলা একাডেমি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে (মীর মশাররফ হোসেন কালচারাল একাডেমি) এর দাবি সমূহ: 


১. নিয়মিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্যে এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে মীর মশাররফ হোসেনকে চির ভাস্বর রাখতে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রে শিশুদের নাচ, গান, আবৃত্তি ও অভিনয় শেখানোর জন্য একটি বিভাগ বা স্কুল চাই।


২. নবাবপুর তথা পুরো বালিয়াকান্দি উপজেলাতে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রের পাঠাগারের পাঠক তৈরি করতে এর প্রচার প্রচারণা এবং প্রয়োজনে শিক্ষার্থী এবং সুশীল সমাজকে পাঠাগারে এসে বই পড়তে উৎসাহিত করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করার দাবি জানাই। 


৩. মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র থেকে যে ২৫% কমিশনে বই কেনা যায় সামাজিক মাধ্যম এবং পত্রিকায় তার প্রচার-প্রচারণা চাই। 


৪. মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রকে পর্যটক বান্ধব করতে এর সাথে সংযুক্ত আরো স্পট তৈরি করার দাবি জানাই। 


৫. রাজবাড়ী জেলার সকল স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসার পাঠাগারে মীর মশাররফ হোসেন এর বই বাধ্যতামূলক ভাবে রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই। 


৬. পদমদীতে শিক্ষাবিদ, সমাজ হিতৈষী বঙ্গদেশে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপনকারী নবাব সৈয়দ মীর মোহাম্মদ আলীর নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় চাই। 


৭. মীর মশাররফ হোসেন পদমদী স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তাই পদমদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু কিশোরদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনকে তুলে ধরতে সেখানে মীর মশাররফ হোসেন কর্নার তৈরির দাবি জানাই। 


৮. আঠারো-উনিশ শতকে শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চার প্রাণ কেন্দ্র পদমদীর নবাব এস্টেটে মীর মশাররফ হোসেন এর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাই। 


যদি যথাশীঘ্র এসকল দাবি বাস্তবায়িত না হয়, তবে আমাদের ঐতিহ্য ও গর্বের পদমদী তথা রাজবাড়ী জেলা কেবল অনুজ্জ্বলই হবে না। বরং একই সাথে যে মহাপুরুষ এই মাটিকে গর্বিত করেছিল আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা আর তাকে তুলে ধরতে পারবো না। পদমদীর আগামী প্রজন্মের কেউ আর কোনোদিন জানবে না এ গ্রামে ছিল নবাবের বাড়ী বা জমিদার বাড়ী, এ ভূমি একদিন ছিল শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। 


মুহাম্মদ বাবলু 

কবি, লেখক, সম্পাদক ও চিত্রনাট্যকার 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)