আপনি আপনার আরামদায়ক জীবনে অবস্থান করে, কখনোই পৃথিবীর রহস্য উদঘাটন করতে পারবেন না। অজানাকে জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই ভ্রমণ করতে হবে। এক পা এগিয়ে আপনি যখন শত মাইলের ভ্রমণ শুরু করবেন, তখনই কেবল বুঝতে পারবেন পৃথিবীতে আপনার অস্তিত্ব কতটা ক্ষুদ্র।
অর্থ, সময়, এনার্জি সবকিছু মিলিয়ে সবসময় পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে কোনো একটা দিক কম্প্রোমাইজ করে নেমে পড়লেই যেকোনো কিছু সম্ভব। আর ভ্রমণের সবচাইতে পারফেক্ট সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন।
এই বয়সে আমাদের সময়, এনার্জি সবই থাকে, কিন্তু অর্থের অভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেককেই বন্ধুদের কে না করতে হয়, "না দোস্ত, যাবো না.... ফ্যামিলি তে একটু প্রবলেম আছে" এই কথা বলে। আমরা ম্যাক্সিমাম ই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা... তাই আমরা সবসময়ই চাই কম টাকায় ভালো একটা ট্যূর দিতে। সেরকম অভিজ্ঞতা থেকেই আপনাদের জন্য কম খরচে কিভাবে বেস্ট একটা ট্যূর দিতে পারবেন, তার বিস্তারিত জানতে পারবেন এই আর্টিকেল থেকে।
আমরা পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচজন শিক্ষার্থী, সম্প্রতি শেষ করে আসা ট্যূর ( চিটাগং - কক্সবাজার - সেইন্ট মার্টিন ) ট্যূরের অভিজ্ঞতার আলোকেই এই আর্টিকেল টা সাজানো হয়েছে। ট্যূরের জন্য সবসময় ৫ জন অথবা ১০ জন এর স্কোয়াড বেস্ট। কেননা আপনাকে বেশ কয়েকটা জায়গায় মুভ করার জন্য সিএনজি প্রয়োজন হবে, আর সিএনজির ধারণ ক্ষমতা ৫ জন। অতএব, ৫ জন এর স্কোয়াড অর্থাৎ ৫ জন ছেলেবন্ধু কে নিয়েই এই ট্যূরের গাইডলাইন সাজানো হয়েছে....
কমলাপুর স্টেশন থেকে ১১:৪৫ এর মেইল ট্রেইনের টিকেট কেটে ফেলুন ১২০ টাকা দিয়ে। ট্রেইন নরমালি ১০ টার সময় প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছায়। ঠিক সময়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালে আপনার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। তবে মেইল ট্রেইন প্রায়শই দেরী করে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছায়। আসন সংখ্যা থেকে যাত্রী সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং টিকিটে নির্ধারিত আসন বিন্যাশ না থাকায় সিট এ বসতে আপনাকে মোটামুটি ছোটখাটো একটা যুদ্ধ জয় করতে হবে।
আপনি ছাত্র মানুষ, পরীক্ষার হলে আপনাকে অনেক যুদ্ধই জয় করতে হয়, ধরে নিচ্ছি এই ছোটখাটো যুদ্ধে আপনি জয়ীদের একজন। অভিনন্দন। যাইহোক সকাল ৮ টার মধ্যে ট্রেইন আপনাকে সীতাকুণ্ড স্টেশনে পৌঁছে দিবে। স্টেশনের পাশেই ওয়াশরুম থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা দিয়ে ভালোমতো সবাই ফ্রেশ হয়ে নিবেন।
তারপর ২-৩ মিনিট হেঁটে সীতাকুণ্ড বাজার থেকে নাস্তা করে নিবেন ৫০-৬০ টাকার মধ্যেই। অবশ্যই চা খেতে ভুলবেন না, যা আপনার সারাদিন এর জার্নির জন্য একটা ফ্রেশ, এনার্জেটিক ভাইব দিবে। নাস্তা শেষ করে জনপ্রতি ২০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে চলে যাবেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে, যেখান থেকে মুলত আপনার 'হিল ট্র্যাকিং' পর্ব শুরু হবে।
এইজায়গা থেকে ট্র্যাকিং এর জন্য জনপ্রতি ৪০ টাকা দিয়ে একটা লাঠি কিনবেন যা ট্র্যাকিং শেষে এসে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিলে ২০ টাকা ব্যাক পাবেন। নিজেদের ব্যাগ, লাগেজ এখানেই দোকানে রাখবেন ২০ টাকা দিয়ে। প্রয়োজনীয় কাপড় চেইঞ্জ করে নিবেন, চেষ্টা করবেন ঢিলেঢালা কাপড় পরিধান করতে। সাথে একটা ব্যাগ ক্যারি করবেন, ব্যাগের মধ্যে স্যালাইন, পানি, হালকা খাবার নিয়ে নিবেন, যা ট্র্যাকিং এর মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার সময় কাজে দিবে। মোটামুটি ১২ টা থেকে ১২:৩০ এর মধ্যেই আপনার চন্দ্রনাথ পাহাড় ট্র্যাকিং শেষ হয়ে যাবে।
এরপর আবার ওই একই জায়গা থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে চলে আসবেন সীতাকুণ্ড বাজারে। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবেন... খাওয়াদাওয়া শেষ করে জনপ্রতি ৩০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে চলে যাবেন গুলিয়াখালী সী বিচ এ। এইখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন। বিকেলের মনোরম পরিবেশ টা অসাধারণ সুন্দর। ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে গাইতে পারেন "ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো"।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে ৩০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে এইবার যাবেন সীতাকুণ্ড বাস স্ট্যান্ডের পাশে। সারাদিনের ক্লান্তি একটু দূর করতে আশেপাশেই ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে একটা হোটেল ম্যানেজ করবেন শুধু গোসলের উদ্দেশ্য। গোসল শেষে আপানার এখন যথেষ্ট ফ্রেশ লাগবে। এরপর চা খেয়ে চিটাগং এর বাসে উঠে পড়ুন। ৫০ টাকা ভাড়া লাগবে চিটাগং শহরে অর্থাৎ আপনাকে অলংকার মোড় এ নামিয়ে দেবে। চিটাগং শহরের মধ্যে চাইলে একটু ঘুরে দেখতে পারেন। অলংকার মোড়েই চিটাগং এর বিখ্যাত মেজবান টেস্ট করে দেখতে পারেন। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের কারোরই ভালো লাগেনি। একদম টাকার অপচয় মনে হয়েছে। তবে আপনি চাইলে টেস্ট করে দেখতে পারেন, হয়তো আপনার কাছে ভালো লাগতেও পারে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে কক্সবাজার এর বাস এ উঠে পড়বেন। অসংখ্য বাস পাওয়া যায়, আপনার পছন্দমতো যেকোনো বাসে উঠে পড়বেন। তবে চেষ্টা করবেন ১১ টার পর যেসব বাস ছাড়ে সেগুলোতে উঠার জন্য। ভোর ৪ টার দিকে আপনাকে কক্সবাজার কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দেবে। ১০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে চলে যাবেন সুগন্ধা বিচ এ। পাবলিক ওয়াশরুম পেয়ে যাবেন এখানে। ফ্রেশ হয়ে সুগন্ধা বিচ এ যেয়ে ২-৩ ঘন্টা ঘুরাঘুরি করতে পারেন। ভোরের দিকে বিচ টা অন্যরকম সুন্দর। কেননা এসময় জোয়ার চলতে থাকে...
মোটামুটি ৭ টার দিকে জনপ্রতি ১২০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে চলে যাবেন ইনানি বিচ এ জাহাজ যেখান থেকে ছাড়ে। ১ ঘন্টার মতো সময় লাগতে পারে। ইনানী তে পৌঁছে সকালের নাস্তা করে নিবেন। তারপর ৯ টার সময় কর্ণফুলি অথবা ১০ টার সময় বার আওলিয়া (যেটার টিকেট কাটবেন) তে উঠে যাবেন। আরেকটা কথা বলে রাখি, চেষ্টা করবেন টিকেট অনলাইনেই কেটে রাখার জন্য। যেহেতু আপনি স্টুডেন্ট, স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটলেই হয়ে যাবে আপনার। এক্ষেত্রে ওয়ানওয়ে টিকেট এর জন্য লাগবে ৬৫০ টাকা এবং আপ-ডাউন টিকেট এর জন্য গুনতে হবে ১৩০০ টাকা। চাইলে আপনি স্পিডবোট এও যেতে পারেন।
অনেকেই স্পিডবোট রিস্কি মনে করেন আবার অনেকে মনে করেন এডভেঞ্চারাস। তবে "Risk is better than regret" এ যারা বিশ্বাসী তারা স্পিডবোট এ যেতে পারেন ভিন্নরকম অভিজ্ঞতার জন্য। এক্ষেত্রে ৭০০-৮০০ টাকার মধ্যে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে আপনাকে চলে যেতে হবে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে জনপ্রতি ৮০০-৮৫০ টাকার মধ্যে স্পিডবোট এর টিকেট কেটে ২০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে পৌছে যাবেন টেকনাফ ঘাটে। স্পিডবোট এ সেইন্ট মার্টিন যেতে ৪০-৪৫ মিনিট সময় লাগে। টেকনাফ দিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আপনার মিয়ানমার সীমান্ত ও দেখা হয়ে যাবে।
জাহাজে গেলে অবশ্য জাহাজের সবুজ গালিচায় বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে মোটামুটি ৪ ঘন্টার মধ্যে সেইন্ট মার্টিন জেটি ঘাটে পৌঁছে যাবেন। এসময় সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে গাঙচিল আপনাদের স্বাগতম জানাবে। জেটি ঘাটে নেমে মেইন রাস্তা ধরে ১০-১৫ মিনিট হাঁটতে থাকবেন। একটু ভেতরের দিকে গেলে আপনি কম দামে থাকার জন্য ভালো হোটেল পাবেন। মোটামুটি ১০০০ বা এর নিচেই আপনি থাকার জন্য রুম পেয়ে যাবেন, যেখানে আপনারা আরামসে ৫ জন থাকতে পারবেন।
এরপর রুমে একটু ফ্রেশ হয়ে চলে যাবেন বিচ এ। বিচ থেকে গোসল, ঘুরাঘুরি শেষ করে রুমে এসে ফ্রেশ হবেন এবং বের হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবেন... এইদিন দুপুরের খাবার একটু লেট হবে আপনাদের জন্য। আজকের দিনের জন্য বাকিসব কিছু অফ রেখে রুমে রেস্ট নিবেন। কেননা শরীর কেও একটু রিল্যাক্সেশন দেওয়া প্রয়োজন। রাতের দিকে বিচ এ হাঁটতে পারেন সবাই।
পরদিন খুব সকালে উঠে ঘন্টাভিত্তিক চুক্তিতে সাইকেল নিয়ে ছুটবেন ছেঁড়া দ্বীপ এর উদ্দেশ্য। ছেড়াদ্বীপ ঘুরে আসতে মোটামুটি ৪ ঘন্টার মতো লাগবে। তাই যে দোকান থেকে সাইকেল ভাড়া নিবেন, আগে থেকেই দরদাম করে মিটিয়ে নিবেন। প্রতিমধ্যে তরমুজ এবং সেইন্ট মার্টিন এর ডাব ট্রাই করতে পারেন।
দুপুরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবেন। সেইন্ট মার্টিন গেলে অবশ্যই ভর্তা-ভাত রেস্টুরেন্ট এর ভর্তা প্যাকেজ টা ট্রাই করবেন। এবার আপনারা নিজেদের মতো করে সেইন্ট মার্টিন এক্সপ্লোর করতে পারেন। হুমায়ুন আহমেদ এর বাংলো টাও একটু দেখে আসতে পারেন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাঁটতে পারেন, সূর্যাস্ত দেখাও হয়ে যাবে। এবার আপনার যদি কোনো কেনাকাটা থাকে, সেটাও করে নিতে পারেন।
অনেকেই সেইন্ট মার্টিন এর মিষ্টি তেঁতুল, শ্যূঁটকি, বাদাম সহ মেয়েদের বিভিন্ন অর্নামেন্টস কিনে থাকে। এরপর রাতের খাবারে সবাই মিলে সামুদ্রিক মাছের বার্বিকিউ ট্রাই করবেন। দেখেশুনে ভালো কোনো রেস্তোরাঁ তে ফ্রেশ মাছ, দামাদামি করে অর্ডার করবেন। কাঁকড়া ফ্রাই ব্যক্তিগতভাবে আমার ফেবারিট, চাইলে ট্রাই করে দেখতে পারেন। সেইন্ট মার্টিনে দ্বিতীয় দিন এভাবেই কাটাতে পারেন।
এখন অব্দি যেটা হয়নি তা হলো সূর্যদয় দেখা। এজন্য খুব সকালে বিচ এ চলে যেতে হবে। ভোরের রাঙা সূর্যের আবহে বেশ কিছু এ্যায়েস্থেটিক ছবি তুলে নিতে পারেন। সেইন্ট মার্টিনে গিয়ে ডিএসএলআর ক্যামেরায় ছবি তুলতে চাইলে বুঝেশুনে ক্যামেরার লেন্স দেখে ক্যামেরাম্যান দের সাথে ডিল করে নিতে হবে। এ ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকবেন। সকাল ১১ টার সময় জাহাজের অফ্লাইন টিকেট বিক্রি শুরু হয়। যদি টিকেট না কেটে থাকেন, কেটে নিবেন। তবে সেইন্ট মার্টিনে জাহাজের টিকেট কাটতে চাইলে একইসাথে আপ-ডাউন টিকেট কাটাই ভালো।
জাহাজে ফিরতে রাত ৮-৯ টা বেজে যাবে। ইনানী থেকে জনপ্রতি ১২০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে একবারে কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে চলে আসবেন। এখানেই ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে পছন্দমতো বাসে করে ঢাকা চলে আসবেন। খুব সকালে বাস আপনাকে ঢাকায় পৌঁছে দেবে।
ট্যূর শেষে মনে হবে অনেক ব্যস্ততায় দিনগুলো কাটিয়েছেন। আপনি যখন ভ্রমণ শেষে একরাশ মন জুড়ানো স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসবেন। তখন আপনি বুঝতে পারবেন এই ভ্রমণ বৃথা যায়নি। আশা করছি এই আর্টিকেল টি আপনারা যারা এখনও সেইন্ট মার্টিন যাননি, তাদের জন্য একটু হলেও নির্দেশিকা হিসাবে কাজ করবে।
ভ্রমণ গাইড: মিজি জুলহাস হোসেন
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ভাই মোটামুটি আপনাদের প্রতিজনের মোট খরচ কত হয়েছে?
উত্তরমুছুনমাত্র ৬০০০ টাকা
উত্তরমুছুন