অমর একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ ছোট গল্প 'রক্তে লেখা বর্ণমালা'
রক্তে লেখা বর্ণমালা
মুহাম্মদ বাবলু
ছেলেটার নাম ফুসরৎ। ওর নাম ফুসরৎ কেন ও তা জানে না। ওর বাবা-মা কেউ নেই। একবার দাদীমা বলেছিলো, ও নাকি ঐ চাঁদ থেকে এসেছে। সেখানে নাকি ওর মা-বাবাও থাকে। তাই রাতের বেশির ভাগ সময় ও রাস্তার পাশে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে। ভাবে একদিন ও ঠিকই ঐ চাঁদের কাছে পৌঁছে যাবে।
এভাবেই রাত কেটে যায় ফুসরৎ এর। তা নিয়ে ওর তেমন কোনো ভাবনা নেই। সকালে সে চোখ মুছতে মুছতেই চলে যায় আলতাব চাচার চায়ের দোকানে। সেখানে গিয়ে রোজকার মতো দোকান ঝাড়ু দেয়। তারপর চা'র জন্য পানি এনে বালতি ভরে। এক কাপ চা আর রুটি খেয়ে সে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। এরপর সারাদিন এ দোকানে সে দোকানে চা টেনে বেড়ায়। অইটুকনই তো একটা ছেলে। বয়স আর কত হবে। এই বছর নয়।
জিগাতলার সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। ফুসরৎ-ও তো খুব লক্ষী ছেলে। ও সবার কথা শোনে। একে ভাই, ওকে চাচা বলে ডাকে। সবাই ওকে খুব আদর করে। তাই ওর তেমন কোনো কষ্ট নেই। এভাবেই দিন যেয়ে রাত, রাত যেয়ে দিন আসে ফুসরৎ এর।
একদিন সে চায়ের দোকানে হারুন ভাইয়ের কাছ থেকে শোনে এক নতুন কথা। হারুন ভাই বড় একটা স্কুলে পড়ে। ওর-ও স্কুলে যাবার অনেক শখ। তবে কে স্কুলে ভর্তি করাবে ওকে? তাই ও সন্ধ্যার পরে হারুন ভাইয়ের কাছে অ,আ,ক,খ পড়তে বসে। পাড়ার অনেক ছেলেমেয়েই আসে। হারুন ভাই বলে, ও নাকি পড়ালেখায় খুব ভালো। ও নাকি একদিন অনেক বড় হবে। হারুন ভাই আসলেই অনেক ভালো মানুষ। সবার কথা ভাবে।
বিকালে ফুসরৎ আলতাব চাচার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে কেন যেন হারুন ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। তারপর গুটি গুটি পায়ে হারুন ভাই'র ঘরে ঢুকে পড়ে। ঘরে গিয়ে একপাশে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে।
হারুন ভাই ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করে, কি রে ফুসরৎ? তুই কখন এলি? আয় এখানে আয়। বস।
ও হারুন ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, ভাইজান আপ্নে যেন সকালে কি এক দৈত্যর কথা কইলেন?
হারুন ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। তারপর ওর পিঠে হাত রেখে বলে। হ রে ফুসরৎ দৈত্য। দৈত্যই তো! ওরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়।
ফুসরৎ চমকে উঠে বলে। কি কন ভাইজান! তাইলে আমরা কথা কমু ক্যামনে? তারপর ও বোবার অভিনয় করতে থাকে। হারুন ফুসরৎ এর দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর ফুসরৎ বলে ওঠে, ভাইজান সত্যই কি দৈত্যরা আমাগো বোবা কইরা দিবো? দৈত্যরা কই থাকে ভাইজান?
হারুন আর কিছু বলে না। কি যেন চিন্তা করতে থাকে।
ফুসরৎ বোবার অভিনয় করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে আসে। সে রাতে ফুসরৎ এর আর ঘুম হয় না। দাদীমার বলা দৈত্যর গল্পগুলো বার বার তার মনে পড়ে।
সকালে সে প্রতিদিনের মতো আজকেও আলতাব চাচার চায়ের দোকানে আসে। আসার পথে কয়েক গাড়ি পুলিশ দেখতে পায় রাস্তায়। দোকানে পৌঁছে দেখে আজ তার আগেই আলতাব চাচা এসে দোকান খুলেছে। রেডিও তে কি যেন সে শুনছে। ফুসরৎ পানি আনতে গেলেই আলতাব চাচা বলে ওঠে। আজ আর পানি আনতে হইবো না তোর। দোহান বন্ধ কইরা দিমু। দেশের অবস্থা বেশি ভালা না।
ফুসরৎ একবার ভাবে সে জিজ্ঞাসা করবে আলতাব চাচার কাছে, কি হয়েছে দেশের? কিন্তু কেন জানি কিছু জিজ্ঞাসা না করে চুপ করে বেরিয়ে আসে ও। একটু এগিয়ে গিয়ে মোড়ের পাশে দাড়িয়ে থাকে।
হঠাৎ-ই ও দেখতে পায় একটা বড় মিছিল। সবার হাতে বড় বড় কাগজে কি যেন সব লেখা। ও সহজেই চিনতে পারে কিছু কাগজে ওর পড়া অ,আ,ক,খ লেখা রয়েছে। কিন্তু ও বুঝতে পারে না সবাই এমন চিৎকার করতে করতে যাচ্ছে কোথায়?
কিছুক্ষণ পরেই ও হারুন ভাইকে দেখতে পায় মিছিলের মধ্যে। ও আনান্দে চিৎকার দিয়ে ভাইজান,ভাইজান বলে ছুটে যেতে থাকে। তখনই মিছিলে কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। হারুন হঠাৎ ফুসরৎ-কে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে। সে চিৎকার করে ডেকে ওঠে ফুসরৎ!
ফুসরৎ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না। ওর মাথা ঘোরে। বুকের একপাশে খুব যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। তারপর ও দেখতে পায় এক ভয়ানক দৈত্য ওকে হারুন ভাইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ও ভাইজান, ভাইজান বলে গোঙরাতে থাকে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই ও দেখে, ওর পড়া সেইসব অ,আ,ক,খ বর্ণমালা। তারপর ও ওর মাকে দেখতে পায়, ওর বাবাকে দেখতে পায়। চাঁদটা কেমন যেন ওর কাছে চলে আসে। ও দৌড়ে যায় ওর মায়ের কাছে। তারপর ওর মায়ের কোলে মাথা রাখে। ওর মা ওকে ঘুম পাড়ানির গান শোনায়। ওর খুব ঘুম পেতে থাকে ও আস্তে আস্তে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।
সমাপ্ত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0মন্তব্যসমূহ