আপনাকে যদি প্রশ্ন করি পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাধর দেশ কোনটি? আপনি হয়তো কিছুক্ষণ ভেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামই বলবেন। কারণ একথা আমরা সবাই জানি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তির দেশে পরিণিত হয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি কেবল মাত্র বিশেষ কিছু কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের জন্যেই সম্ভব হয়েছে। এখন যদি বলি সেই কোম্পানিগুলোর নাম বলুন তো? আপনি হয়তো কোনো কিছু না ভেবে বলবেন মাইক্রোসফট, ফেসবুক,অ্যাপল, গুগল ইত্যাদি। তবে আপনি কি এটি জানেন যে এই ফেসবুক, অ্যাপেল, মাইক্রোসফট বা গুগলের মত বড় বড় কোম্পানিগুলো কারা নিয়ন্ত্রণ করে?
আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের এই কোম্পানিগুলো শুধু মাত্র একটি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে। যার নাম ভ্যানগার্ড গ্রুপ। হ্যা, ভ্যানগার্ড গ্রুপ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাদের হাতেই রয়েছে পৃথিবীর ৭০ ভাগ সম্পদ। তারা চাইলে যে কোনো সময় পৃথিবীর যে কোনো দেশের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু কিভাবে তারা চাইলেই সেটি করতে পারবে? কিংবা এত ক্ষমতার অধিকারি হওয়া সত্বেও কেন এই কোম্পানির নাম সবার সম্মুখে কখনো আসে না সেটিই জানাবো আমাদের আজকের ব্লগে।
ভ্যানগার্ড গ্রুপ! যার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় $7.7 ট্রিলিয়ন ডলার। আপনি কি জানেন এক ট্রিলিয়ন ডলার সমান কত টাকা? এক ট্রিলিয়ন ডলার সমান এত টাকা যা আপনি একমাসেও হাতে গুনে শেষ করতে পারবে না। যেখানে এক ট্রিলিয়ন ডলার ইনকাম করতে পুরো এশিয়া মহাদেশের সকল মানুষের এক মাসেরও বেশি সময় লাগে, সেখানে ভ্যানগার্ড গ্রুপের একারই রয়েছে ৭.৭ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ! বলা হয় ভ্যানগার্ড BlackRocks এর পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ড (ETFs) কোম্পানি । পৃথিবীর যে দুটি কোম্পানি সারাবিশ্বের শেয়ার বাজার ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ব্লাকরক এবং ভ্যানগার্ড হলো সেই দুটি প্রতিষ্ঠান৷ ব্ল্যাক রকস নিয়ে আমরা আরেকটি এপিসোডে কথা বলবো। আজকে আমরা শুধু ভ্যানগার্ড গ্রুপ নিয়েই আলোচনা করব।
১৯৫১ সাল, ভ্যানগার্ড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জন সি. বোগল তখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ছিলেন। ফাইনাল ইয়ারে ভার্সিটিতে থিসিসপেপার জমা দেওয়ার জন্য তিনি একটি থিসিস শুরু করেন। এই থিসিস নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে বেশিরভাগ মিউচুয়াল ফান্ড স্টক মার্কেটের শেয়ারের তুলনায় খুব বেশি অর্থ উপার্জন করে না । তখন তার মাথায় একটি আইডিয়া আসে। তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে আরো বেশি অর্থ উপার্জন করা যায়।
১৯৫১ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরপরই, বোগল ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে, তিনি বোস্টনে অবস্থিত একটি ফান্ড ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের সাথে যুক্ত হন। তিনি ১৯৭০ সালে গ্রুপটির সিইও হন। তবে সেখানে তার থিওরি সফল হয়নি। ব্যর্থতার দায়ে ১৯৭৪ সালে কোম্পানিটি থেকে বোগলকে বরখাস্ত করা হয়। এ নিয়ে পরবর্তীকালে বোগল বলেছিলেন, যদি ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থেকে আমাকে তখন বহিস্কার না করা হত, তাহলে ভ্যানগার্ড কখনোই তৈরি হত না।
ভ্যানগার্ড এর নামকরণ নিয়েও আছে মজার ঘটনা। বোগল নীল নদের যুদ্ধে একটি যুদ্ধ জাহাজ এইচএমএস ভ্যানগার্ডের নামানুসারে তিনি এর নামকরণ করেন ভ্যানগার্ড। তিনি এই নামটি নির্বাচন করেছিলেন একজনের ফেলে যাওয়া একটি বই পড়ে। ওয়েলিংটন এক্সিকিউটিভরা প্রাথমিকভাবে এই নামটিকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে তা অনুমোদন পায়। বোগলের তৈরি করা মিচুয়াল ফান্ড ওয়েলিংটন এক্সিকিউটিভরা মূল ফান্ডের সাথে জড়িত করতে কোম্পানিকে প্রস্তাব দেয়। বোগল এ ঘটনায় কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে।
১৯৭৬ সালে, ওয়েলিংটনের পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর, বোগল ফার্স্ট ইনডেক্স ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (এখন ভ্যানগার্ড 500 ইনডেক্স ফান্ড নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল প্রথম দিকের প্যাসিভ ইনভেস্টিং ইনডেক্স ফান্ডগুলির মধ্যে একটি। যা প্রথমে তেমন সারা ফেলতে না পারলেও ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
১৯৮২ সালে বোগলের এই ইন্ডেক্সিং মডেলটি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে, ভ্যানগার্ড প্রাইমক্যাপের সাথে সহযোগিতায় ভ্যানগার্ড প্রাইমক্যাপ ফান্ড চালু করে । এবং ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে, ভ্যানগার্ড তার দ্বিতীয় মিউচুয়াল ফান্ড চালু করে, একটি বন্ড সূচক তহবিল যাকে বলা হয় টোটাল বন্ড ফান্ড, যা ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের কাছে দেওয়া প্রথম বন্ড সূচক তহবিল ছিল। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে, ভ্যানগার্ড তার তৃতীয় তহবিল, ভ্যানগার্ড এক্সটেন্ডেড মার্কেট ইনডেক্স ফান্ড, একটি সূচক তহবিল চালু করে। এভাবে একের পর এক ভ্যানগার্ড তহবিল চালুর ফলে ৯০ এর দশকে ভ্যানগার্ড বিশ্বের বৃহত্তম মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানিতে পরিণত হয়।
বর্তমানে ৭.৭ ট্রিলিয়ন সম্পদের মালিক ভ্যানগার্ড। যা ২০৬০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রধান বৃহত্তম বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হতে চলেছে। গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন এমন কোনো বড় কোম্পানি নেই যেখানে ভ্যানগার্ডের বিনিয়োগ নেই। সারা পৃথিবীতে রয়েছে তাদের বিনিয়োগ।
তারা যদি হঠাৎ করেই এই বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয় তাহলে অনেক বড় বড় কোম্পানি পথে বসে পড়বে। সেই সাথে সেসকল দেশের অর্থনীতিতেও চরম ধস নামবে। আর অর্থনীতি ধস নামা মানেই হলো অর্থ সম্পদ কমে যাওয়া। ফলে দেশের দ্রব্য মূল্যের দাম হুর হুর করে বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষকে তিনবেলা ঠিকমত না খেতে পেয়ে জীবন যাপন করতে হবে। দেশের নাগরিকেরা চাকরি হারাবে ও বেকার হয়ে পড়বে। আর ঠিক এ কারণেই বলা হয় ভ্যানগার্ড চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো দেশের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0মন্তব্যসমূহ