পৈশাচিক কিছু নারী প্রথা! যা জানলে ভয়ে আপনার শরীর কাটা দিয়ে উঠবে

লিপির আলো
By -
0
social practice of violence against women-lipir-alo


বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণের সমন্বয়ে ভারত উপমহাদেশ গঠিত। বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন নিজেদের বিভিন্ন প্রথার মাধ্যমে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। সমাজের সেই সকল প্রথার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যায় যা যুগ যুগান্তর ধরে ভারতীয় নারীদের ওপরে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা করে গেছে ও বহুলভাবে সফলও হয়েছে।


মূক, অবলা, নিরীহ বলে নারীদের যাবতীয় নৈতিকতা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের বিভিন্ন রীতি রেওয়াজের ঘেরাটোপে বন্দী করে রাখার চেষ্টা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টাই সর্বদা চলেছে ভারতবর্ষে।


বিগত কয়েক শতাব্দী যাবৎ ভারতীয় নারীদের অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হলেও প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে, তাদের অবস্থার যে অবনতি ঘটেছিল এবং বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা যা ভারতীয় নারীকে অদৃশ্য শিকল পরিয়ে রেখেছে, তাই হল আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়।


তখনকার দিনে নারী শুধুই গৃহকোণের আবরণ হিসাবে বিবেচিত হত। সাথে ছিল পাশবিক ও বর্বর কিছু প্রথার দ্বারা অমানবিক অত্যাচার।


কি ছিল সেই পৈশাচিক প্রথাগুলো তাই আজ জানার চেষ্টা করব আমরা। উল্লেখযোগ্য কিছু নারী প্রথা যা বর্বরোচিত সমাজে ছিল:


১. কুমারী প্রথা বা সুতো প্রথা


এই প্রথায় কুমারী মেয়েদের কৌমারীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়,যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তারা কুমারী কিনা। একটি সাদা দড়ি বা সুতো মেয়েদের শরীরের ব্যক্তিগত জায়গা অর্থাৎ যৌনাঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। যদি সাদা সুতোটি রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়, তাহলে প্রমাণিত হয় যে মেয়েটি কুমারী অর্থাৎ তার কৌমারীত্ব নষ্ট হয়নি। এই প্রথাটি রাজস্থানের ‘সানসি’ নামক একটি উপজাতির মধ্যে দেখা যায়। যদি কোন মেয়েকে বাঁধা ওই সুতোটি রক্তে ভিজে না যায়, তাহলে ওই মেয়েটি পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না। আর প্রচারিত হয় যে মেয়েটির চরিত্রদোষ আছে আর তার কৌমারীত্ব সেই কারণেই নষ্ট হয়েছে। তখন তার ওপরে শুরু হয় সামাজিক অত্যাচার। মেয়েটিকে বর্বর ভাবে প্রচন্ড মারা হয় আর তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, বিবাহের পূর্বে কোন পুরুষের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক হয়েছে। যখনই সেই মেয়েটি নাম বলে কোন পুরুষের, তখনই ক্ষতিপুরণ বাবদ মেয়েটির বাবা মা ছেলেটির থেকে একটি বিশাল অর্থ দাবী করে। 


২. জল দ্বারা চারিত্রিক বিশুদ্ধতার পরীক্ষা 


নারীকে তার সততা আর কৌমারীত্বের জন্য বরাবর সেই রামায়ণ, মহাভারতের যুগ থেকেই বিভিন্ন পুরুষচালিত বর্বর ও আদিম প্রথায় পরীক্ষা দিতে হয়েছে। নারীর ওপরে বর্বর, পাশবিক অত্যাচারগুলো আস্তে আস্তে যুৃগ যুগান্তরে একেকটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। এরকমই আরেকটি প্রথা হল জল দ্বারা বিশুদ্ধতার পরীক্ষা যা প্রধানত উত্তর ভারতে করা হত। এই পরীক্ষায় যে মেয়েটির বিশুদ্ধতা যাচাই হবে, তাকে জলের তলায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকতে হবে, তখন জলের ওপরে একজন পুরুষ একশত পা হাঁটবে। ওই একশত পা হাঁটার মধ্যে যদি ওই মেয়েটি নিঃশ্বাস ধরে রাখতে পারে, তাহলে সে অতি পুণ্যবতী ও শারীরিক বিশুদ্ধতার পরীক্ষায় পাশ করবে। তার চরিত্র নিয়েও আর কোন প্রশ্ন উঠবে না। কিন্তু জলের তলায় অতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে রাখা শুধু কষ্টকরই নয়, প্রায় অসম্ভব। সুতরাং এই মেয়েটি যে চারিত্রিক দিক থেকে নির্মল নয়, সেটা খুব সহজেই প্রমাণিত হত এবং তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যেত।


৩. অগ্নিপরীক্ষা 


সমস্ত বিবাহিত মহিলার জন্য এই প্রথা ছিল তাদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমাণের একমাত্র এবং ভয়ঙ্কর এক প্রথা। নতুন বউকে নিজের সতীত্ব ও চারিত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণার্থে গাছের পাতা দিয়ে তৈরি বাটির মধ্যে আগুনে লাল হয়ে যাওয়া গরম লোহা হাতের ওপরে ধরতে হত এবং সেই অবস্থায় হাঁটতে হত। তার হাত যদি প্রচন্ড গরমে পুড়ে যেত, তাহলে তাকে কলঙ্কিনী, চারিত্রিক দোষ যুক্তা বলে গণ্য করা হত। বলা বাহুল্য, সেই নতুন বউটির পরিণাম হত ভয়াবহ। হাত পুড়ে যাবার যুক্তিতে সেই বউয়ের ওপরে শুরু হত অমানবিক অত্যাচার। সমাজের ঘৃণ্যতর অত্যাচারের শিকার এমন বহু নারী গোপনীয়তার মধ্যেই মৃত্যু মুখেও পতিত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ঘৃণ্য ও বর্বর প্রথাটি ভারতীয় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। 


৪.সতী বা সতীদাহ প্রথা


সতীদাহ হচ্ছে হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে অর্থাৎ আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা, যা রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় বন্ধ হয়। সতীদাহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা একটি পুরানো প্রথা, যেখানে বিধবা মহিলারা স্বামীর মৃত্যুর পরে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। যদিও বিধবাদের এই প্রথায় অংশগ্রহণ স্বেচ্ছায় বলে ধরা হত, কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনায় হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণে বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর পরে সম্পত্তির অধিকার পাবার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাকঢোল, কাঁসর, করতাল, শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় জোর করে শুইয়ে পুড়িয়ে মারতো। এই নৃশংস ও পাশবিকতার মধ্যে দিয়ে তারা নিজেরা বর্বর আনন্দ লাভ করত এবং মৃত ব্যক্তির যাবতীয় সম্পত্তির অধিকার লাভ করত।


৫.দেবদাসী প্রথা


এটি মূলত দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত একটি প্রথা। মহিলারা কোনো দেবতার মন্দিরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন এবং এরপর তাঁদের সামাজিক বিবাহ থেকে বিরত থাকতে হত। তাঁরা দেবতার সেবা করার জন্য নিজেদের সারা জীবন উৎসর্গ করতেন। প্রথাটি ১০ম শতাব্দী থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৯৮৮ সালে এই প্রথাটি দেশে বেআইনি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু দেশের কিছু অঞ্চলে নিম্ন বর্ণের মেয়েরা এখনও দেবদাসী হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে তারা বারাঙ্গনা, বেশ্যা হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হয়। আগে মূলতঃ রাজা, জমিদার ও পুরোহিতবর্গের সেবাদান অর্থাৎ মনোরঞ্জনের জন্য তারা নিজেদের বাল্যকাল থেকে প্রস্তুত করতো কঠোর অধ্যবসায় দ্বারা নৃত্যগীত চর্চার মাধ্যমে। নিজেরা দেবতার চরণে সমর্পিত হত বা কখনো তাদের লুঠ করে নিয়ে আসা হত। কখনো বা ক্রয়বিক্রয় করে দেওয়া হত। নিজেদের শরীরের বিনিময়ে তাদের খুশি রাখতে হত সমাজের সকল সমাজপতিদের। 


৬. জহর প্রথা


এই প্রথার চর্চা ভারতে আলাউদ্দিন খিলজির আক্রমনের সময় রাজস্থানের চিতোরে শুরু হয়।যুদ্ধে পরাস্ত হবার পরে রাজপুত রমণীরা পরপুরুষের হাতে নিজেদের সম্মান খোয়াবার ভয়ে, আত্মসম্মান রক্ষার্থে বিশাল অগ্নিকুন্ডে আত্মাহুতি দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করত। এই প্রথা হিন্দু রাজপুত রমণীদের বীরাঙ্গনায় পরিণত করেছিল।


তবে এ সকল প্রথার সবই প্রায় এখন বিলুপ্ত। তারপরও সমাজ থেকে এখনো বন্ধ হচ্ছে না কন্যাশিশু হত্যা, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা। আমরা সব সময়ই এমন সব ঘৃণ্য প্রথার বিরোধীতা করি। নারী আমাদেরই মা,বোন,স্ত্রী,কন্যা। তারা অহিংস সমাজে বেড়ে উঠুক এটাই আমাদের কাম্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)